হার্টের জন্য ক্ষতিকর খাবার গুলি জানুন এবং এড়িয়ে চলুন- ভালো থাকুন
মানবদেহের সবচেয়ে সক্রিয় অঙ্গের কথা যদি বলা হয়, তাহলে সেই তালিকায় হার্টের আশেপাশে আর কোনও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নেই। সারাদিন পর রাতের ঘুমে চোখের বিশ্রাম হয়, ক্লান্তি দূর হয় শরীরের অন্যান্য অংশের। একটা সময় আমাদের মস্তিষ্কও বিশ্রাম নিতে শুরু করে। কিন্তু হার্ট? তার বিশ্রাম নেই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। প্রতিদিন লক্ষবার এর কম্পনে আমাদের শরীরে রক্তচলাচল ঠিক থাকে, সেইসাথে অক্সিজেন আর কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে আলাদা করে আমাদের বাঁচিয়ে রাখে এই হার্ট। আর তাই, সুস্থ্যভাবে বেঁচে থাকতে হলে সুস্থ্য রাখতে হয় আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অবধারিত এই হৃদপিন্ডকে।
কিন্তু কিভাবে হার্টকে সুস্থ্য স্বাভাবিক রাখা যায়? এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো আপনাকে কোনও জিম ট্রেইনার দিতে পারবে না। কারন শরীরের প্রায় সব অংশের জন্যই কোনও না কোনও ব্যায়াম রয়েছে, কিন্তু এই হার্টের সুস্থ্যতা পুরোটাই নির্ভর করে আপনি কি খাচ্ছেন, তার উপর। তাই আজ আমরা আপনাদের এমন কিছু খাবারের খবর দিবো, যা হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
আপনার হার্টের জন্য ক্ষতিকর খাবার | আশ্চর্যজনক বিপদ
হার্টের জন্য ক্ষতিকর খাবার করতে গেলে একদম প্রথম যেই নামটা সবার আগে চলে আসে, সেটি হচ্ছে গরুর মাংস। ভোজনপ্রিয় বাঙালীর পাতে যখন এই মাংসের টুকরোগুলো উঠে, তখন জিভে যে পানি চলে আসে, স্বাভাবিক। কিন্তু এই মাংসই যে হার্টের জন্য ক্ষতিকর খাবার ভীষণ ক্ষতিকর, তা বলে শেষ করা যাবে না।
আসলে শুধু গরুর মাংস না, খাসি, ভেড়া থেকে শুরু করে যেকোনও ধরনের লাল মাংসই আপনার হৃদপিন্ডের জন্য ক্ষতিকর। আমাদের হৃদপিন্ড বা হার্টের মাংসপেশী হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সক্রিয়। আর এই মাংসপেশীর জম হচ্ছে স্যাচুরেটেড ফ্যাট আর কোলেস্টেরল, যার দুটোই রয়েছে এই লাল মাংসে।
তাহলে কি লাল মাংস খাবো না? ব্যাপারটা এমন নয়। অবশ্যই খাবেন, কিন্তু কবজি ডুবিয়ে, পেট ভরে নয়। পরিমাণমতো লাল মাংস খেলে তা শরীরের মাংসপেশী বৃদ্ধি ও শক্তির সঞ্চয় করতে সাহায্য করে। লাল মাংস প্রোটিনের সবচেয়ে ভালো উৎসগুলোর মধ্যে একটি। তবে এর উপকারীতা ভোগ করতে হলে, মাসে দুই তিনবার, অল্প পরিমাণে খাওয়া ভালো। লাল মাংসের বদলে সাদা মাংস, যেমন মুরগি, পাখির মাংস, কিংবা মাছ নিয়মিত খেতে পারেন। এগুলোতে যেমন কোলেস্টেরল আর ক্ষতিকর ফ্যাটের পরিমাণ কম, তেমনি এগুলোতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন।
হার্টের জন্য ক্ষতিকর খাবার
তালিকার এবারের যেই খাবারটার নাম নিবো, এটা শুনে অনেকের মন খারাপ হয়ে যেতে পারে। যেই মাছ আর ভাত আমাদের সবচেয়ে পছন্দের খাবার, সেই ভাতই হচ্ছে হার্টের জন্য আরেক ক্ষতিকর খাবার। অবিশ্বাস্য, তাই না?
আসলে ভাতের এই তালিকায় থাকার কথা ছিলো না। এর পিছনের কারণ হলো, আমরা বাজার থেকে যেই চাল কিনে নিয়ে আসি, তাকে সুন্দর, ঝকঝকে, সাদা করে বাজারজাত করা হয়। চালের এই চকচকে ভাব আনতে গিয়ে এর পুষ্টিমানের অনেক উপাদান, যেমন উপকারী ফাইবার, মিনারেলস, ভিটামিন নষ্ট হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের পাতে যেই চালের ভাত উঠে, তার প্রায় পুরোটাই থাকে প্রোসেসড। ফাইবার আর মিনারেলের অভাবে, এই ভাতের শর্করা ভেঙ্গে খুব দ্রুত তা সুগারে পরিণত হয়, যা আমাদের শরীরে জমা হতে শুরু করে।
এই সুগার পরবর্তীতে চর্বিতে পরিণত হয়, যার প্রভাব এসে পরে হৃদপিন্ডের উপর। একসময় হৃদস্পন্দনে বাধা আসে, আর্টারিটে ফ্যাট জমে যায়, শরীরে হানা দেয় ডায়বেটিসের মতো রোগ। তাই ভাত যদি খেতেই হয়, সাদা ভাতের পাশাপাশি লাল চালের ভাত, কিংবা একদম ধান থেকে বের করে আনা চালের ভাত খাওয়ার চেষ্টা করুন। ভাতও খাওয়া গেলো, আবার বাঙালীয়ানাও বজায় থাকলো!
তবে তালিকার এই খাবারটিকে কোনও উপায় করেই খাওয়া যাবে না। জ্বি, আমরা এখন ফাস্ট ফুডের কথা বলতে যাচ্ছি। কি নেই এই ফাস্ট ফুডে? তেল, লবণ, চর্বি, লাল মাংস… হার্টের যত শত্রু রয়েছে তার সবগুলোই এই একজায়গায় এসে দল পাকাবে। স্যাচুরেটেড ফ্যাট, কোলেস্টেরল, ক্ষতিকর প্রোসেসড ফুড, পুরোনো তেলে ডুবিয়ে ভাজা এই ফাস্টফুড রীতিমত নিষিদ্ধ শরীরের জন্য। শুধু হার্ট নয়, পাকস্থলী, কিডনি, ফুসফুসের মতো অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বারোটা বাজিয়ে দেয় এই ফাস্টফুড।
তবে তাই বলে এই নয় যে এই খাবার খাওয়াই যাবে না। হ্যা, লাল মাংসের চাইতেও অনেক কম পরিমাণে খাওয়া যেতে পারে। মাসে একটা বার্গার, এক পিস পিজ্জা, ছোট্ট একটা বোলের মধ্যে বেকড পাস্তা, খাওয়াই যায়। তবে সেটা মাসে একবারই।
এবার আসি তালিকার সবচেয়ে বিভ্রান্তকর খাবারটি নিয়ে। ডায়েট কোক।
এখন এর নাম শুনে প্রশ্ন জাগতে পারে, আরে! ডায়েট কোক তো সুগার ফ্রি! তাহলে এইটা আবার কিভাবে শরীরের জন্য
ক্ষতিকর হবে? হার্টের স্বাস্থ্যের সাথে ডায়েট কোকর সম্পর্ক কি?
প্রথমেই বলে রাখি, ডায়েট কোক মার্কেটে ফ্যাট-ফ্রি এবং জিরো-ক্যালোরি বলে প্রচার চালালেও, আদতে ব্যাপারটা এমন নয়। ডায়েট কোকের মূল সমস্যা হচ্ছে মানুষের সাইকোলজিতে। অনেকেই মনে করেন, ডায়েট কোক খেলে শরীরে যেহেতু একদমই ক্যালোরি, ফ্যাট, সুগার ঢুকছে না, আমি একটু আধটু ফ্যাট, ক্যালোরি, সুগারযুক্ত অন্য খাবার অনায়াসে খেতে পারি। আর এমন চিন্তা থেকে অনেকে দিনশেষে হার্টের জন্য ক্ষতিকর খাবার গুলি অন্যান্য খাবার বেশি খেয়ে ফেলেন।
তাহলে ডায়েট কোক বাদ দিয়ে নরমাল সোডাই খাবো? একদম না। এক বোতল সোডায় যেই পরিমাণ চিনি বা সুগার থাকে, তা একজন মানুষের সারাদিনের চিনির চাহিদা পূরণ করে দিতে পারে। যেখানে যদি কেউ সারাদিনে কয়েক বোতল সোডা খেয়ে বেড়ায়, তাহলে শরীরের উপর ডায়বেটিস, হাই সুগারের চাপ পড়বেই। তাই ডায়েট কোক অবশ্যই এগুলোর চাইতে ভালো বিকল্প। কিন্তু, সেটা যেন অন্য খাবার খাওয়ার লাইসেন্সে পরিণত না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
তালিকায় এবার আমরা কথা বলবো তেল নিয়ে। তেল আমাদের রান্নার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও, এর জন্য আমাদের হার্টের অনেক ক্ষতি হয়। তালিকার মধ্যে এই একটিমাত্র খাবার, যাকে বাদ দেয়ার উপায় খুব একটা নেই।
হ্যা, তেল আমাদের শরীরে ফ্যাট এবং অন্যান্য মিনারেলস এর চাহিদা পূরণ করতে পারে, তবে সব তেল এই কাজ করতে পারে না। আমরা যেই সয়াবিন তেল, রাইস ব্রাউন অয়েল কিংবা সরিষার তেল খাচ্ছি, তা আমাদের শরীরে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি এনে দিচ্ছে। আর এই ক্ষতির প্রথম ধাক্কাটা গিয়ে লাগছে আমাদের হার্টে। কার্ডিওভাসকুলার জনিত সমস্যার প্রধান কারণ হচ্ছে এই বাজারজাত করা তেল। অথচ একটা সময় ছিলো, যখন আমাদের খাদ্যতালিকায় এই তেলের অস্তিত্ব ছিলোই না। আমাদের খাবারের তালিকায় সরিষার তেল এর অস্তিত্ব বহুবছর ধরেই আছে, তবে সয়াবিন তেল কিংবা রাইস ব্রাউন অয়েলের স্থান হয়েছে এই কয়েকদিন আগেই। আগে আমাদের খাবারের তালিকায় ছিলো ঘি, বাদাম তেল, নারিকেল তেলের মতো বিকল্প। এগুলো যেমন স্বাস্থ্যের জন্য ভালো, তেমনি ক্ষতিকর স্যাচুরেটেড ফ্যাটও শরীরে তৈরি হওয়া থেকে বিরত থাকতো।
কিন্তু ঘি এর কথা শুনে আবার কেউ মাখনের কথা তুলবেন না! ঘি আর মাখন গরুর দুধ থেকে আসে সত্যি, কিন্তু মাখনে মিল্ক সলিডস থাকায় তা ক্ষতিকর ফ্যাটে পরিণত হতে পারে। তাই মাখনের চেয়ে ঘি সেরা বিকল্প।
সারাংশ:
আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় এমন অনেক খাবার ও খাদ্যদ্রব্য রয়েছে, যা আমরা চাইলেই বাদ দিতে পারবো না। চিনি, তেল, লবণ, এগুলো হার্টের জন্য ক্ষতিকর হলেও, পরিমিত খাদ্যগ্রহন, নিয়মিত ব্যায়াম এবং পরিকল্পিত জীবনধারণের মাধ্যমে হৃদপিন্ডের বিপদ অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব। তাই সপ্তাহে একবার একটু মিষ্টিমুখ করা, মাসে দুয়েকবার মাংস খাওয়ার ইচ্ছা যদি থাকে, তাহলে পরিকল্পনামাফিক জীবনযাত্রা আজই শুরু করুন। যেই হার্ট আপনাকে বাঁচিয়ে রাখছে,